নাশকতার পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের সংগঠিত করতে খোদ রাজধানীতে বাসা ভাড়া নিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শীর্ষ নেতা এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টার। তবে তাঁর সেই পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ দেওয়ার আগেই গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলার একটি বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এ সময় ওই বাসা থেকে একটি পিস্তল, গুলি, পৌনে তিন লাখ টাকা, রাসায়নিক দ্রব্য, দেশি পদ্ধতিতে তৈরি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও বেশ কিছু জিহাদি বই জব্দ করা হয়।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গতকাল বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান। সম্মেলনে তিনি বলেন, উজ্জ্বল মাস্টার জেএমবির একটি অংশের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর আগে আরো তিনবার গ্রেপ্তার হয়ে শেষবার তিনি জামিনে বের হয়ে ফের জঙ্গিবাদ বিস্তারে তৎপর ছিলেন। তাঁর নির্দেশে জেএমবি সদস্যরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ডাকাতি করে অর্থ সংগ্রহ করছিলেন। এই শীর্ষ জঙ্গি নেতা একসময় জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই ও সালাহউদ্দিন সালেহীনের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে জেএমবি নেতৃত্বহীন হয়ে পড়লে সাংগঠনিক দুর্বলতা তৈরি হয়। ফলে তারা বিচ্ছিন্নভাবে স্বতন্ত্র কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় জঙ্গি নেতা এমদাদ ওরফে উজ্জ্বল মাস্টার তাঁর বিশ্বস্ত ও পুরনো জেএমবি সহযোগীদের সংগঠিত করে একটি গ্রুপ তৈরির চেষ্টায় ছিলেন। তিনি এই গ্রুপের মূল কর্ণধার ও সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন।
র্যাব জানায়, জ্জ্বল মাস্টারের গ্রুপে অর্ধশতাধিক অনুসারী রয়েছেন। উজ্জ্বল মাস্টার নতুন নেটওয়ার্ক তৈরি করে ময়মনসিংহ, জামালপুর, উত্তরবঙ্গসহ কয়েকটি জেলায় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
কে এই জঙ্গি এমদাদ ওরফে উজ্জ্বল মাস্টার : ময়মনসিংহের একটি কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ১৯৯৫ সালে স্থনীয় একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন উজ্জ্বল মাস্টার, কিন্তু জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার কারণে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ায় চাকরিচ্যুত হন তিনি। ২০০২ সালে মুক্তাগাছায় সফররত এক জঙ্গি নেতার বয়ান শুনে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হন। পরবর্তী সময়ে তিনি শায়খ আব্দুর রহমানের কাছ থেকে বায়াত গ্রহণ করেন। এরপর বেশ কয়েকজন সহযোগীসহ জামালপুরে একটি আস্তানায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। এভাবে জঙ্গি তৎপরতার মাধ্যমে অতি দ্রুত তিনি ময়মনসিংহের একজন আঞ্চলিক নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি ময়মনসিংহে অবস্থানের সময় জেএমবির বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। গোপন আস্তানায় অবস্থান করে মিটিং ও বয়ান আয়োজনে ভূমিকা রাখতেন তিনি।
এমদাদ থেকে ছদ্মবেশী উজ্জ্বল মাস্টার : জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, ২০০৭ সাল থেকেই আত্মগোপনে থেকে মাঠ পর্যায়ে জেএমবি সদস্যদের সংগঠিত করছিলেন এই শীর্ষ নেতা। ২০০৮ সাল থেকে তিনি ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ছদ্মবেশে নাম পরিবর্তন করে অবস্থান নেন। আত্মগোপনে থাকাকালীন সময়ে তিনি কখনো কাপড়ের দোকানের কর্মচারী, কখনো খেলনা বিক্রি, কখনো ফেরিওয়ালা বেশে ঘুরে বেড়াতেন। আবার কখনো রিকশা চালাতেন। এমনকি রাজমিস্ত্রির কাজও করেছেন তিনি।
ইতিপূর্বেও দুইবার গ্রেপ্তার : আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযানে ২০১২ সালে তিনি রাজধানীর উত্তরা এলাকা থেকে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। দুই বছর পর জেল থেকে জামিনে বের হন। ২০১৫ সালে ফের বিস্ফোরকসহ গ্রেপ্তার হন। ফের ২০১৬ সাল জামিনে বের হন। এরপর আত্মগোপনে চলে গিয়ে বিভিন্ন ছদ্মবেশে রাজবাড়ী, রংপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় অবস্থান করেন তিনি। সেই সঙ্গে তিনি সেই জঙ্গিবাদসংশ্লিষ্টতা বজায় রাখেন।
বসিলায় বাসা ভাড়া নেয় যেভাবে এই জঙ্গি : চলতি মাসের ২ তারিখে ভবনটির দোতলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন এমদাদ মাস্টার। বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় প্রিন্টিং প্রেসে কাজ করার কথা বলেছিলেন বাড়ির ম্যানেজারকে। পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে পরিবারের লোকজন এলে জাতীয় পরিচযপত্র দেবেন—এমন শর্তে বাসাটি ভাড়া নেন তিনি। বাসাটিতে আরো দুই ব্যক্তির আসা-যাওয়া ছিল। গতকাল ভোর থেকে ওই বাড়িতে তাঁর অবস্থানের খবর পেয়ে র্যাবের ডগ স্কোয়াড ও বোম ডিসপোজাল ইউনিট অভিযান চালায়।র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার জেএমবি চার সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বসিলায় জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায়। গ্রেপ্তার জঙ্গিরা জিজ্ঞাসাবাদে বসিলার জঙ্গির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য দেন র্যাবকে। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব ঢাকার বাইরে জামালপুর, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করে। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে মধ্যরাত থেকে বসিলা জঙ্গি আস্তানাটিতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে জেএমবির এক শীর্ষ নেতা এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টারকে আটক করা হয়। ##