১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে শক্তিপীঠ সীতাকুণ্ডে শঙ্করমঠে শ্রীমৎ স্বামী ব্রহ্মানন্দ পরমহংসের নির্দেশে স্বামী স্বরূপানন্দ শঙ্কর মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। আনুমানিক নভেম্বর – ডিসেম্বর বা বঙ্গাব্দের কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের কোন একটি পবিত্র দিনে তিনি শঙ্কর মঠকে বাংলার পূর্বাংশে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন।শ্রীমৎ স্বামী ব্রহ্মানন্দের শিষ্য স্বরূপানন্দের সাথে ছিলেন তার কাকা গুরু ব্রহ্মানন্দের শিষ্য স্বামী নীলানন্দ সরস্বতী মহারাজ। স্বামী নীলানন্দই মহারাজই শঙ্কর মঠ নামকরণের প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাবটি স্বানন্দে অনুমোদন করেন, স্বামী ব্রহ্মানন্দ। তিনি তাঁর অধস্তন শিষ্যদের নির্দেশনা প্রদান করেন যে, সীতাকুণ্ডে অবস্থিত সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের মঠটি হবে শ্রীশঙ্করাচার্যের ভাব আদর্শের উপরে। সে লক্ষ্যে তিনি মঠটিকে শ্রীশঙ্করাচার্যের দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের ‘গিরি’ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করেন। গিরি তারা যারা গিরি গুহায় বসবাস করে সর্বদা শ্রীমদ্ভগবদগীতার চর্চা করে। এ গিরি সম্পর্কে শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর জ্যোতির্মঠান্নায়তে বলেন:
বাসো গিরিবনে নিত্যং গীতাধ্যয়নতৎপরঃ ।
গম্ভীরাচলবুদ্ধিশ্চ গিরিনামা স উচ্যতে॥(জ্যোতির্মঠান্নায়:৬)
“যিনি পার্বত্য গিরিকাননে বাস করে সর্বদা গীতা অধ্যয়ন করেন; গম্ভীর ও স্থিরবুদ্ধি, তাঁকেই ‘গিরি’ নামে অবিহিত করা হয়।”
১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে শ্রীমৎ স্বামী ব্রহ্মানন্দ মহাসমাধি লাভ করেন। তাঁকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সীতাকুণ্ড শঙ্কর মঠের অভ্যন্তরে যোগগুহা ভবনের উপরে সমাধিস্থ করা হয়। এরপরে নবীন শঙ্কর মঠের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শ্রীমৎ স্বামী স্বরূপানন্দ। তিনি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত নেতৃত্ব প্রদান করেন।১৯৫০ খ্রিস্টব্দে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপরে নৃশংস সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস পরবর্তীতে তিনি কোলকাতায় চলে যান। স্বামী স্বরূপানন্দ শেষ জীবনে পশ্চিমবঙ্গের হালিশহরে বসবাস করেন। সেখানেই তাঁকে মহাসমাধি দেয়া হয়। ১৯৫০ পরবর্তীতে কোলকাতা চলে যাওয়ার সময়ে তিনি একটি উইল করে যান।সে উইলে প্রধান মঠের প্রধান সেবায়েত হিসেবে নিযুক্ত করেন, তাঁর যোগ্য শিষ্য স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ মহারাজকে। স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ১৭ বছর বয়সে স্বামী স্বরূপানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে গুরুদেব স্বরূপানন্দ এবং শঙ্কর মঠের সেবায় নিযুক্ত হন।স্বামী স্বরূপানন্দের স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ মহারাজ ছাড়াও অনেক ত্যাগী সন্ন্যাসী শিষ্য ছিলেন, তাঁদের প্রচেষ্টাতেই সীতাকুণ্ড শঙ্কর মঠটি দেশভাগ পরবর্তীকালে অত্যন্ত বিরূপ পরিস্থিতিতে এগিয়ে যায়। সেই ত্যাগী শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম হল, শ্রীমৎ স্বামী বাসুদেবানন্দ, শ্রীমৎ স্বামী অভয়ানন্দ, শ্রীমৎ স্বামী বিশ্বেশ্বরানন্দ, শ্রীমৎ স্বামী কালিকানন্দ, শ্রীমৎ স্বামী বিজয়ানন্দ, শ্রীমৎ স্বামী ওঙ্কারানন্দ প্রমুখ।
১৯৫১ খ্রিস্টব্দে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শ্রীমৎ স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ গিরি মহারাজ। তাঁর নেতৃত্বে মঠটি একজন যোগ্যতম যোগীপুরুষের নেতৃত্বে পরিচালিত হতে থাকে। তাঁর জন্ম হয় চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার রাজাপুর গ্রামে। ১৩১৫ বঙ্গাব্দের ৫ অগ্রহায়ণ, ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২২ নভেম্বর শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে তাঁর জন্ম হয়। পূর্বাশ্রমে তাঁর নাম ছিল শ্রীযতীন্দ্রমোহন শর্মা।পিতার নাম শ্রীশরৎচন্দ্র শর্মা এবং মাতার নাম শ্রীমতি সত্যবতী শর্মা। শিশুকাল থেকেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী বিদ্যার্থী ছিলেন। তিনি সেই অত্যন্ত মেধা এবং প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রাখেন শঙ্কর মঠের নেতৃত্বভার গ্রহণ করে। তিনি চট্টগ্রামসহ সমগ্র বাংলাদেশে শ্রীমদ্ভগবদগীতা এবং শ্রীশঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বৈদান্তিক সিদ্ধান্ত প্রচার করেন।দেশের সাথে সাথে তিনি বিদেশেও প্রচার করেন।১৯৫৯-১৯৬১ সাল পর্যন্ত বার্মায় গীতা প্রচার করেন।এতে তার নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পরে।সে সময়ের দেশ বিদেশের প্রচারের বিবরণ মঠের ‘পাঞ্চজন্য’ পত্রিকার লিপিবদ্ধ রয়েছে। বার্মায় প্রচারের সময়ে সেখান থেকে একটি বৃহৎ ঘণ্টা শিষ্যদের থেকে উপহার পেয়েছিলেন। ঘন্টাটি ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর রাজাকার লুণ্ঠনকারীরা লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়।
শ্রীমৎ স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ মহারাজের বার্মাসহ সারাদেশে প্রচারে একটি আধ্যাত্মিকতার ঢেউ শুরু হয়। তিনি আধ্যাত্মিক চর্চার সাথে সাথে শক্তি ঔষধালয়, সাধনা ঔষধালয়ের মত ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের শুরুতেই একটি আয়ুর্বেদিক ঔষধ তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চেয়েছেন বিভিন্ন প্রকারে মঠকে স্বর্নিভর করতে। কিন্তু বিধিবাম! শ্রীমৎ স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ মহারাজ মঠকে কিছুটা প্রচারের আলোয় এনে শক্তিশালী কাঠামোগত পরিবর্তন শুরু করেন, ঠিক সে সময়েই চলে আসে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ফরিদপুরে জগদ্বন্ধু সুন্দরের ‘শ্রীঅঙ্গন’ এবং শ্রীরাম ঠাকুরের কৈবল্যধাম আশ্রমের মত শঙ্কর মঠেও স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় সাম্প্রদায়িক নৃশংসতা চালায়। এ বর্বরোচিত সাম্প্রদায়িক নৃশংসতায় নিত্যানন্দ নামে এক সন্ন্যাসী গীতা ভবনে নিহত হন। তিনি তখন শ্রীমদ্ভগবদগীতা পাঠ করছিলেন।আরেকজন সন্ন্যাসী মঠে গোসেবায় ছিলেন। সন্ন্যাসীগণ হয়ত ভেবেছিলেন যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হয়ত সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের প্রতি বিদ্বেষ করবেন না। কিন্তু তাদের নিস্পাপ হৃদয়ের সরল বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণিত করে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের হত্যা করে। তাদের দোসর রাজাকারেরা সম্পূর্ণ আশ্রমকে লুণ্ঠন করে। এর ফলশ্রুতিতে শুধু ভুমি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না মঠে।
বিভিন্ন ঘটনার অভিঘাতে শ্রীমৎ স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ গিরি মহারাজ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের জলেফা সাব্রুম আশ্রমে নয়মাস অতিবাহিত করেন। জলেফা সাব্রুম আশ্রমটি ত্রিপুরা সরকারের বরাদ্দকৃত খাসজমির পাহাড়ে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হলেও, মূলত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই সময়ে কাঠামোগত সমৃদ্ধি লাভ করে গড়ে উঠে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের অসংখ্য মানুষ সেই আশ্রমের শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে আবার নতুন করে শ্রীমৎ স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ গিরি মহারাজ পুনর্গঠনের দুরূহতম কাজ শুরু করেন। তাঁর প্রাথমিক লক্ষ্যই থাকে বিধ্বস্ত আশ্রমকে যথাসাধ্য সচল রাখা। যুদ্ধের ভয়াবহ ধাক্কা কাটিয়ে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মঠ পুনরায় পূর্বের মত শ্রীমদ্ভগবদগীতা প্রচার শুরু করেন। সাথে মঠ মন্দির সংস্কার ও সনাতন ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।এই পূতকর্মে অনেক উচ্চশিক্ষিত যুবক যুক্ত হন। যাঁরা পরবর্তীতে সন্ন্যাসী হয়ে মঠের সাথে যুক্ত হয়ে যান।তাঁদের মধ্যে বর্তমান শঙ্কর মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী তপনানন্দ মহারাজ অন্যতম। সাথে স্বামী বিবোধানন্দ (বিবেকানন্দ) যিনি পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত আশ্রম করেছেন। স্বামী তেজসানন্দ, যিনি ননদ্বীপ শঙ্কর মঠের দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়াও স্বামী মুক্তানন্দ, স্বামী সন্তোষানন্দ মহারাজ প্রমুখ।
পাকিস্তান আমলেই গীতা ভবন তৈরি হয়। ভবনটি নির্মানে তৎকালীন পঁচিশ হাজার টাকার অর্থসাহায্য করেন বার্মার ভক্তবৃন্দ। গীতা ভবনে প্রথমে চার প্রহরের উদয়াস্ত গীতা পাঠ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালে অখণ্ড গীতাপাঠ। শ্রীমৎ স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ মহারাজ গীতা ভবনের দ্বিতল নির্মান করে সে ভবনে অখণ্ড শ্রীমদ্ভগবদগীতা পাঠের সাথে আরেকটি বিষয় যুক্ত করেন, সে বিষয়টি হল অখণ্ড প্রদীপ স্থাপন। এ অখণ্ড প্রদীপটি ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান অব্দি দীপ্যমান হয়ে শঙ্কর মঠের অদ্বৈত বৈদান্তিক সিদ্ধান্তের প্রজ্জ্বলিত প্রতীকে পরিণত হয়ে আছে।
একটি সময়ে বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীকালে মঠে ভয়ংকর দারিদ্র্যতা গ্রাস করে।কিন্তু মঠে অখণ্ড শ্রীমদ্ভগবদগীতা পাঠ এবং অখণ্ড প্রদীপ স্থাপনের পরে মঠের সকল দারিদ্র্যতা পর্যায়ক্রমে বিদূরিত হতে থাকে। এবং মঠ ধীরেধীরে স্বচ্ছল হতে থাকে। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে মঠে সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠা করা হয়।সংস্কৃত কলেজ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মহানাম সম্প্রদায়ের আচার্য ড.মহানামব্রত ব্রহ্মচারী। হিন্দু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির নিদর্শন হিসেবে, একতলা ভবনটি উদ্বোধন করানো হয় কমলাপুর বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ শ্রীবিশুদ্ধানন্দ মহাথেরোকে দিয়ে।এ ভবনটি নির্মানে সকল প্রকারের অর্থনৈতিক সাহায্য সহায়তা করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বংশোদ্ভূত সন্ন্যাসী স্বামী পরমানন্দ।
শ্রীমৎ স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ মহারাজ ধর্ম প্রচারে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণের শতবর্ষ পূর্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শঙ্করমঠের প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।আমেরিকায় তিনি শিষ্য তপনানন্দকে মহারাজকে সাথে নিতে অদ্বৈত বেদান্ত প্রচার করেন। স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ মহারাজ ২০০০ খ্রিস্টাব্দেও অসুস্থ দেহে পুনরায় বেদ-বেদান্ত প্রচারে গমন করেন। তাঁর সুযোগ্য নির্দেশনায় ১৯৮০ থেকে ২০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থানেই শঙ্কর মঠের শাখা সংস্থাপিত হয়। এর মধ্যে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা, বিলুনিয়া; পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বারাসাত, কোন্নগর, হরিণঘাটা এবং বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি শাখা।
১৯৯৭ সালে শঙ্কর মঠের অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয় দশজন ছাত্রকে সাথে নিয়ে। পরবর্তীতে অনাথ আশ্রমটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধনকৃত হয়।
২০০২ খ্রিস্টাব্দে বার্ধক্য জনিত কারণে এবং শ্বাসকষ্টে অসুস্থ হয়ে যান শ্রীমৎ স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ মহারাজ। তিনি উপলব্ধি করতে পারেন, তাঁর তিরোধানকাল আসন্ন। তাই তিনি তাঁর পরবর্তী উত্তরসূরীর নাম ঘোষণা করেন। সেই যোগ্য অধিকারী উত্তরসূরী হলেন, শ্রীমৎ তপনানন্দ মহারাজ। তাঁর জন্ম চট্টগ্রামের মেলঘর পটিয়াতে। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কোঠারী হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় তিরোধান বরণ করেন, শ্রীমৎ স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ মহারাজ। মৃত্যু পরবতী তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় বারাসাত শঙ্কর মঠে। স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ মহারাজের তিরোধান পরবর্তীতে মঠের আনুষ্ঠানিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শ্রীমৎ স্বামী তপনানন্দ গিরি মহারাজ। তখন থেকেই তিনি শঙ্কর মঠের অধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শঙ্কর মঠের জ্যোতি দেশবিদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। শ্রীমদ্ভাগবতের তৃতীয় স্কন্ধে সাধুর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে:
তিতিক্ষবঃ কারুণিকাঃ সুহৃদঃ সর্বদেহিনাম্।
অজাতশত্রবঃ শান্তাঃ সাধবঃ সাধুভূষণাঃ।।
(শ্রীমদ্ভাগবত:৩.২৫.২১)
” যিনি সহিষ্ণু, করুণায় যার হৃদয় পরিপূর্ণ এবং যিনি সকলের সুহৃদ। যিনি কাউকে শত্রুতার দৃষ্টিতে দেখেন না, সর্বদাই যিনি শান্ত স্বভাবের, যিনি সকল প্রকারের সদগুণের দ্বারা বিভূষিত হয়ে শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে আচরণ করেন -এ সকল লক্ষণ যাঁর মাঝে অবস্থিত তিনিই সাধু নামে অভিহিত।”
শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে বর্ণিত এ সকল বৈশিষ্ট্যই স্বামী ব্রহ্মানন্দ থেকে স্বামী জ্যোতিশ্বরানন্দ মহারাজ পর্যন্ত গুরু পরম্পরায় বাহিত হয়ে বর্তমান অধ্যক্ষ এবং আচার্য শ্রীমৎ স্বামী তপনানন্দ গিরি মহারাজের মাঝে পাওয়া যায়। এ কারণেই শঙ্কর মঠ প্রতিষ্ঠানটি দৈবীকৃপায় উত্তরোত্তর উৎকর্ষ এবং প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
২০০৮ খ্রিস্টাব্দে জ্যোতিশ্বরানন্দ গিরি মহারাজের জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে বারাসাতে মঠে তৈরি নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীতে আন্তর্জাতিক ওঙ্কার মন্দির।২০১০ খ্রিস্টাব্দে শঙ্কর মঠে শ্রীমদ্ভগবদগীতাযজ্ঞসহ বিবিধ প্রকারের যজ্ঞের জন্য একটি যজ্ঞশালা নির্মাণ করা হয়। সে যজ্ঞশালা নির্মাণে অর্থায়ন করে সন্ধ্যারাণী সাহা নামা ফেনীর এক ভক্ত।
২০১১ খ্রিস্টাব্দে বনায়নের উপর প্রধানমন্ত্রী থেকে পুরষ্কার লাভ করে শঙ্কর মঠ। এ পুরষ্কারটি বর্তমান আচার্য এবং অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী তপনানন্দ মহারাজ মঠের পক্ষে গ্রহণ করেন। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে শঙ্কর মঠে তীর্থযাত্রীদের জন্য একটি আধুনিক যাত্রী নিবাস তৈরি করা হয়। এতে অর্থায়ন করে চট্টগ্রামের খ্যাতিমান দাতা শ্রীঅদুলকান্তি চৌধুরী।
২০১২ খ্রিস্টাব্দে ভগবান শিবের পবিত্র ভূমি হরিদ্বারে শঙ্কর মঠের শাখা সংস্থাপিত হয়।
২০১৬ খ্রিস্টাব্দে শঙ্কর মঠে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হিসাবে গ্রহণ করা হয়, দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম কাশীর বিশ্বনাথের নামে শ্রীবিশ্বনাথ মন্দির। ২০২১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের ১৬ তারিখ অত্যন্ত পবিত্র ক্ষণে প্রাচীন এবং আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর সংমিশ্রণে নির্মিত এ অপূর্ব মন্দিরটির দ্বারোদঘাটন হবে। এ মাধ্যমেই স্বপ্নপূরণ হবে স্বামী ব্রহ্মানন্দ থেকে জ্যোতিশ্বরানন্দ গিরি মহারাজের অসমাপ্ত স্বপ্নযাত্রা। স্বামী ব্রহ্মানন্দ পরমহংসদেব তাঁর সুবিখ্যাত ‘যোগ সংগীত’ নামক খাম্বাজ রাগিণীর এক আধ্যাত্মিক সংগীতে বলেছেন:
“হে ! ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ডোদরী ব্রহ্মাণ্ড তোর পেটের মাঝে,
আমি ব্ৰহ্মাণ্ড ছাড়িয়া যেতে তোর শঙ্খ ঘন্টা বাজে। উদরেতে ছেলে রাখি, কাটাইলি আজীবন,
জন্মবন্ধ্যা নারীর স্বরূপ বুঝতে নারি তুইমা কেমন ? কৈ তোর প্রসব বেদনা, (আমি) পেটে থেকে ডাকি মা মা,
তোর প্রসবিনী শক্তি নাই তাই পেটের ছেলে পেটে মজে।।
ছেলের জন্ম না হইতে, গড়ে রেখেছ নানা ভাণ,
অষ্টপাশ রজ্জুতে বেন্ধে, মোহ করে হরবি জ্ঞান ।
এ কঠিন ভাব যার হৃদি মাঝে, তার নাম কি অভয়া সাজে,
লোকে বলে জগন্মাতা বিমাতার ভাব দেখি কাজে৷।
জঠর যন্ত্রনা পেয়ে ব্রহ্মানন্দ অনুদিন
পরম পিতার শরণ নিয়ে শোধ করিব কৰ্ম্মঋণ।
মা মা বলে আর ডাকিব না, কুহকে পড়ে আর মজিব না,
বিশ্বনাথের আনন্দ ভেরী, শুনি ঐ ওম্ ওম্ বাজে৷।”
স্বামী ব্রহ্মানন্দ পরমহংসদেব মহামায়ার মায়ার ফাঁদে না পড়ে বিশ্বনাথের আনন্দলোকের মঙ্গলালোকে গমন করে সদা ওম্ ধ্বনির মাঝে একাত্ম হতে চেয়েছেন। সকল পাপরাশিবিনাশী এবং সকল আনন্দের যিনি মূল সেই কাশীর শ্রীবিশ্বনাথ শিবের মহিমা বর্ণনা করে, সেই শ্রীবিশ্বনাথের শরণাগত হয়েছেন শ্রীশঙ্করাচার্য। এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘দ্বাদশলিঙ্গশিবস্তোত্র’ স্তোত্র রয়েছে। সে স্তোত্রে শ্রীশঙ্করাচার্য বলেছেন:
সানন্দমানন্দবনে বসন্তম্
আনন্দকন্দং হতপাপবৃন্দম্।
বারাণসীনাথমনাথনাথং
শ্রীবিশ্বনাথং শরণং প্রপদ্যে ॥
(দ্বাদশলিঙ্গশিবস্তোত্র:৭)
“আনন্দকাননে সর্বদা সানন্দে অবস্থিত, পাপরাশিবিনাশী, সকল আনন্দের যিনি মূল, অনাথনাথ বারাণসীনাথ শ্রীবিশ্বনাথের শরণাগত হচ্ছি।”
শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই দশপ্রকার দশনামী সন্ন্যাসীদের সনাতন ধর্মপ্রচারে আলস্য ত্যাগ করে সদা সক্রিয় থাকার আদেশ দিয়েছেন তাঁর তৈরি ‘মঠানুশাসনে’। সেই মঠের অনুশাসনে ধর্মরক্ষার্থে করনীয় বর্জনীয় সকল সাংগঠনিক রূপরেখা পাওয়া যায়। চট্টগ্রামের দেবীপীঠ সীতাকুণ্ডে অবস্থিত শঙ্কর মঠ ও মিশন শ্রীশঙ্করাচার্যের দশনামী সন্ন্যাসী সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত গিরি সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী। শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে যে মঠানুশাসন প্রদান করেছেন, সেই মঠানুশাসনের প্রায় সম্পূর্ণ প্রতিফলন পাওয়া যায় শঙ্কর মঠ ও মিশনে। বিষয়টি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক।
যত বিনষ্টির্মহতী ধর্মস্যাত্র প্রজায়তে।
মান্দ্যং সন্ত্যাজ্যমেবাত্র দাক্ষ্যমেব সমাশ্রয়েৎ।।
ন জাতু মঠমুচ্ছিদ্যাদধিকারিণ্যুপস্থিতে।
বিঘ্নানামপি বাহুল্যাদেষ ধর্ম সনাতনঃ।।
(মঠানুশাসনম্ : ৫, ১১)
“হে আমার সন্ন্যাসীবৃন্দ ( দশনামী), এই সময়ে ধর্মের মহতী হানি হয়েছে, তাই এই সময়ে সন্ন্যাসীদের ধর্মপ্রচারে মন্থরতা অবশ্য পরিত্যাজ্য। ধর্মপ্রচারে সর্বদা দক্ষতার আশ্রয় করবে অর্থাৎ আলস্য ত্যাগ করে ধর্মপ্রচারে সদা তৎপর হবে।
হে সন্ন্যাসীবৃন্দ তোমাদের বলছি, ধর্মপ্রচারে বিঘ্ন যতই অধিক হোক, উপযুক্ত অধিকারী, যথোক্ত গুণসম্পন্ন আচার্য থাকলে, কেউ কখনও আমার মঠ উচ্ছেদ করতে পারবে না। যেহেতু আমাদের ধর্মই সনাতন। অর্থাৎ উপযুক্ত উপদেশকেই সনাতন ধর্মের রক্ষক এবং ধর্মের প্রচারে উপযুক্ত উপদেশকের অভাব হইলে সেই মঠ অকর্মণ্য।”
লেখক : কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী, সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়