খুলনা ব্যুরো :
খুলনার তেরখাদা উপজেলার বিআরবি আজগড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় চত্বরে কয়েক বছর আগে গণহত্যার একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। সম্প্রতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ও শহীদ মিনার নির্মাণ কাজ চলছে। তবে বিদ্যালয় চত্বরে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এসব স্থাপনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চরম অনিহার অভিযোগ উঠেছে প্রধান শিক্ষক রমেন্দ্র নাথ মল্লিকের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এসব স্থাপনা নির্মাণের প্রধান অন্তরায় প্রধান শিক্ষককের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী প্রতিকারের দাবি জানিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে এ ব্যাপারে মৌখিক ও লিখিত আবেদনও জানানো হয়েছে। তারই প্রেক্ষিতে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে উত্থাপিত অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে বিশেষ সংস্থা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালে বিআরবি আজগড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় চত্বরে গণহত্যার একটি স্মৃতি ফলক নির্মিত হয়। গত ৯ এপ্রিল খুলনার জেলা প্রশাসনের অর্থায়নে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করা হয়েছে। এছাড়া মুজিববর্ষকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘বঙ্গবন্ধু স্টেটম্যান অব দ্যা সেন্সুরি’ শীরোনামে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ম্যুরাল নির্মাণ করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এসব ঐতিহাসিক নিদর্শন নির্মিত হওয়ায় বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ এলাকার সর্বস্তরের মানুষ খুশি। তবে প্রশ্ন উঠেছে প্রধান শিক্ষকের ভুমিকা এবং অদৃশ্য খুটির জোর নিয়েও।
বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সদস্য সুজিত কুমার মল্লিক জানিয়েছেন, বিদ্যালয়টি ২৭ বছর আগে স্থাপিত হলেও আজ পর্যন্ত একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়নি। সম্প্রতি বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি মল্লিক সুধাংশুর আবেদনের প্রেক্ষিতে খুলনা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে একটি শহীদ নিমার নির্মাণে ১ লাখ টাকা অনুদান বরাদ্দ করা হয়েছে। ৯ নভেম্বর জেলা প্রশাসক মোঃ মনিরুজ্জামান শহীদ মিনার নির্মাণ কাজের উদ্বোধনও করেন।
সুজিত মল্লিকের অভিযোগ, শহীদ মিনার নির্মাণ যাতে না হয় সেই চক্রান্তে লিপ্ত প্রধান শিক্ষক। নিয়মানুযায়ী একটি প্রকল্প কমিটির মাধ্যমে অনুদানের অর্থ উত্তোলন সাপেক্ষেকে কাজ করতে হয়। ম্যানেজিং কমিটির সভায় বহুবার প্রধান শিক্ষককে প্রকল্প কমিটির সভাপতি হওয়ার জন্য অনুরোধ করা সত্বেও শহীদ মিনার নির্মাণ কমিটির সভাপতি প্রধান শিক্ষক রমেন্দ্র নাথ মল্লিক হবেন না বলে স্পষ্ট ভাবে তিনি ম্যানেজিং কমিটির সভায় জানিয়ে দেন।বিদ্যালয় চত্বরে নির্মাণাধীন জাতির পিতার ম্যুরালের ভাস্কর শিল্পী মৌমিতা রায়ের জানান, জাতির পিতার ম্যুরাল নির্মাণের সার্বিক দায়িত্ব আমার ওপর অর্পন করা হয়। যে কারণে প্রথমেই আমাকে অবকাঠামো নির্মাণের জন্যে মাঝে মধ্যে বিদ্যালয়ে যেতে হয়েছে। তবে এটা খুবই পরিতাপের বিষয় অবকাঠামো নির্মাণের শুরু থেকেই আমাকে বাধার সম্মুখিন হতে হয়েছে। প্রধান শিক্ষক রমেন্দ্র নাথ মল্লিক রীতিমত অশ্লীল আচরণ করেছে আমার সাথে। আমি লিখিত ভাবে বিষয়টি বিদ্যালয়ের সভাপতিকে জানিয়েছি। তিনি কাজের পরিবেশ যাতে বিঘ্নিত না হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমাকে ম্যুরাল নির্মাণ কাজ এগিয়ে নেয়ার অনুরোধ করেছেন।
২০১৭ সালে বিদ্যালয়ে একটি গণহত্যার স্মৃতিফলক নির্মিত হয়। ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র’ প্রকল্পের আওতায় এটি নির্মাণ করা হয়। অভিযোগ রয়েছে এটি নির্মাণকালে প্রধান শিক্ষক রমেন্দ্র নাথ মল্লিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নির্মাণ কাজ দেখতে যাওয়া কর্মকর্তাদের সাথে অসহযোগিতামুলক আচরণ করেছেন। এব্যাপারে ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের তৎকালিন ট্রাস্টি ডাক্তার বাহারুল আলম জানান, এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে বিদ্যালয়ের সভাপতির কাছে তখন অভিযোগ করা হয়। আমি যতদুর জানি সভাপতির পদক্ষেপের পরও প্রধান শিক্ষক বিরূপ মন্তব্য থেকে বিরত থাকেননি।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রী শম্পা মল্লিক জানান, আমাদের বহুদিনের দাবি ছিলো বিদ্যালয়ে একটি শহীদ মিনার করা। তবে কখনও সেই উদ্যোগ নিতে দেখিনি প্রধান শিক্ষক বা অন্য কাউকে। শুধু তাই নয়, যখন আমরা হেড স্যার কে এ ব্যাপারে বলতাম তখন তিনি আমাদের ওপর চটে যেতেন। আমি ওই বিদ্যালয়ে এসএসসি পাশ করেছি। কোনদিন তাকে ক্লাস নিতে দেখিনি। ভালো কাজেও তার কোন আগ্রহ নেই দেখিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা শুভংকর রায় জানান, বর্তমান সভাপতি বিদ্যালয়টিকে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তারই আলোকে তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ঐতিহাসিক এই নিদর্শগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে প্রধান শিক্ষকের বিরূপ আচরণ সম্পর্কে আমরা অবহিত। তাই শেষ পর্যন্ত কি হবে এ ব্যাপারে চিন্ত বাড়ছে।
আজগড়া গ্রামের বাসিন্দা জয়বাংলা ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক গুরুদাস মল্লিক জানান, গ্রামের মানুষের অনুভুতিকে বরাবরই ব্দ্ধৃাঙ্গুলি দেখিয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছেন প্রধান শিক্ষক। তাকে কখনও কোন ভালো কাজ করতে দেখিনি। তিনি মোটেই সামাজিক লোক না। আমরা শংকিত বর্তমানে বিদ্যালয়ে জাতির পিতার ম্যুরাল বা শহীদ মিনার নির্মাণ প্রধান শিক্ষকের চক্রান্তে বন্ধ না হয়ে যায়। কেন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ঐতিহাসিক নিদর্শনে অনিহা প্রধান শিক্ষকের’ এমন প্রশ্নের জবাবে গুরুদাস জানান, বিএনপি পন্থী প্রধান শিক্ষক এখনও স্বপ্ন দেখে আবার বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় আসবে। প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
প্রধান শিক্ষক সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বিদ্যালয়ের এক সিনিয়র শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, হেড মাস্টার বলেছেন, এসব হলে যদি কখনও বিএনপি ক্ষমতায় আসে তখন বিদ্যালয়ের এমপিও বাতিল হবে। তাই যতটা দুরে থাকা যায় ততোটাই ভালো।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রমেন্দ্র নাথ মল্লিক এর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণে শিল্পী মৌমিতা রায়কে নিষেধ এবং তার সাথে অশ্লীল আচরণ সম্পর্কিত প্রশ্নের কোন সন্তোষজনক জবাব না দিয়ে তিনি বলেন, আমি মৌমিতাকে চিনি না। গণহত্যার স্মৃতিফলক নির্মাণের সময় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে অসৌজন্য মুলক আচরণ কেন করা হলো-এমন প্রশ্নের জবাবও কৌশলে এড়িয়ে যান।
বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি সাংবাদিক মল্লিক সুধাংশু জানান, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এসব স্থাপনা নির্মাণের বিরুদ্ধে চক্রান্তসহ প্রধান শিক্ষক রমেন্দ্র নাথের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ রয়েছেএলাকার মানুষের। অনেকবার সতর্ক করা হয়েছে। তার অসদাচরণে চরম ভাবে ক্ষুব্ধ সর্বস্তরের মানুষ। বিষয়টি পদস্থ কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। এবার ব্যবস্থা গ্রহণের সময় এসেছে। তার মতে, বিদ্যালয় চত্বরে জাতির পিতার ম্যুরাল বা শহীদ মিনারের কাজ বন্ধ হওয়ার কোন সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
উল্লেখ্য, উত্তর খুলনার তেরখাদা উপজেলার একটি গ্রামের নাম আজগড়া। পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস এই গ্রামে। এক সময়ে এই গ্রামের মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস ছিলো কৃষি কাজ ও মৎস্য শিকার। শিক্ষার সুযোগ না থাকা এবং আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে গ্রামে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা ছিলো হাতে গোনা কয়েকজন। তাও আবার স্কুলের গন্ডি পেরোনা শিক্ষার্থীরা ছিলোনা বললেই চলে। আর নারী শিক্ষা ছিলো অন্ধকারে। তবে ১৯৯৪ সালে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠত হওয়ার পর বর্তমানে সেই গ্রামের চিত্র পাল্টে গেলেও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের থোড়াই কেয়ার আচরণ আবারো গ্রামটিকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।