রাসেল কাজী, চালনা পৌরসভা :
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রৌদ্র তাপে গ্রামীণ জীবন যখন ওষ্ঠাগত তখন মাটির দেয়ালে গড়া চৌচালা, আটচালা ও জোড়া বাংলাঘরগুলো যেন ‘গরিবের এসি। এখন আর আগের মত দেখা মেলে না গোলপাতায় বা খড়ে ছাওয়া মাটির সেই ঘরগুলো। সাধারণত গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারে দেখা যেত বৈঠকখানা বা দহলুজঘর। যেগুলো এখন কালের পরিবর্তনে ও উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় বিলুপ্তির পথে। আজ সেই শান্তির নীড় মাটির ঘরের স্থানে গড়ে উঠেছে টিনের ঘর ও ইট-পাথরের দালান। এক সময়ের ছায়া ঘেরা সবুজের সমারোহ চিরচেনা গ্রামগুলোকেও তাই এখন অনেকটাই অচেনা লাগে।
সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকে প্রাকৃতিক উপাদান দিযে ঝড়-বৃষ্টি থেকে বাঁচার পাশাপাশি তীব্র গরম ও কনকনে শীতে আদর্শ বসবাস-উপযোগী এসব ঘর তৈরি করা হতো। প্রবীণদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, এঁটেল মাটিকে কাদায় পরিণত করে নরম সেই মাটি দিয়ে দুই-তিন ফুট চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হত। ১০-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালের ওপর কাঠ বা বাঁশের চাল তৈরি করে খড়-কুটা, গোলপাতা, টালি অথবা ঢেউটিন দিয়ে ছাওয়া হতো। মাটি কুপিয়ে ও পানি দিয়ে কাদায় পরিণত করার পদ্ধতিকে জাব বলা হয়। জাব কেটে তা সুচারুভাবে গেঁথে ভাজে ভাজে তৈরি করতে হয় দেয়াল। দেয়ালের একেকটি ভাজের পুরত্ব তিন থেকে চার ফুট। এভাবে পাঁচ থেকে ছয়টি ভাজ শেষ হওয়ার পর দেয়ালের উচ্চতা দাঁড়ায় ১৫-১৮ ফুট। যিনি মাটির চাপ গেঁথে দেয়াল ও বাঁশ দিয়ে চাল তৈরি করেন তাকে ঘরামি বলা হয়।
ঘরের বারান্দা ও চালের ধরনের ওপর ভিত্তি করে ঘরকে বিভিন্ন নামকরণ করা হয়ে থাকে। চারপাশে বারান্দা থাকা ঘরকে আটচালা এবং তিনপাশে বারান্দা থাকা ঘরকে সাতচালা ঘর বলা হয়। গৃহিণীরা মাটির দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আল্পনা একে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন। শৈল্পিক আল্পনায় ফুটে উঠতো নিপুণ কারুকার্য। দেয়াল গাঁতার সময় কলা গাছ ঢুকিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ও নকসায় রাখা হতো আলো বাতাস চলাচলের নানান ঢং এর পথ।
বৈঠকখানা বা দহলুজঘরে এক সময় বসতো গ্রামের মানুষের আড্ডা, বিনোদন আর গল্পের আসর। সাধারণ মানুষ তাদের সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, মান-অভিমান, আনন্দ-বেদনা প্রকাশ করতেন মোড়ল বা মাতবরেরা এ দহলুজঘরে বসে। হুকোয় টান দিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিতেন।
ভূমিকম্প বা বন্যা না হলে একটি মাটির ঘর শত বছরেরও বেশি স্থায়ী হয়। অথচ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বর্ষা মৌসুমে মাটির ঘরের ক্ষতি হয় বলে ইট-সিমেন্টের ঘর নির্মাণে উৎসাহী হচ্ছে মানুষ। আধুনিকতার ছোঁয়া আর কালের আবর্তে তাই দালান-কোঠা আর অট্টালিকার কাছে হার মানছে মাটির ঘর।
এক সময় খুলনা, বাগেরহাট সাতক্ষীরা জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই দেখা যেত অনেক পরিবার মাটির ঘরে বাস করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। আশির দশকেও এসব গ্রামে কাঁচা ঘরবাড়ি দেখা যেত।
শান্তিপ্রিয় গ্রামের ধনী গরীব সকলের প্রিয় শান্তি প্রদায়ী মাটির ঘরের ভীড়ে ইট-পাথরের তৈরি পাকা দালানের সংখ্যা ছিল তখন হাতেগোনা। সেই দিন আজ বদলে গেছে। কাঁচাঘর ফেলে পাকাঘর নির্মাণে ঝুঁকছেন গ্রামের মানুষ। ফলে হাতেগোনা দু’একটি মাটির ঘর আজও দেখা যায়। অধিকাংশ বাড়ি এখন টিনের ছাউনি আর ইট পাথরের তৈরি।
আজ গ্রীষ্মের তাপদাহে গ্রামীণ জীবন যখন ওষ্ঠাগত তখন খড়ের ছাউনিতে মাটির দেয়ালে গড়া সেই ঘরটিই যেন “গরীবের এসি”।